দন্ত্যস রওশন, পথের পাশেই তুমুলের ক্লাস। জানালা দিয়ে রাস্তার সব কিছুই দেখা যায়। ভয় শুধু টিচারের।
‘অ্যাই ছেলে, জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকিস কেন?’ টিচারের এ কথায় তুমুল লজ্জা পায়। চোখ ঘুরিয়ে নিতে হয় তাকে।
জানালার বাইরে বড় বড় গাছ। গাছের পাশ ঘেঁষেই রাস্তা। নানা ধরনের লোক চলাচল করে। তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে তার ভালো লাগে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে এমন হয় যে মাঝে মাঝেই সে অন্যমনস্ক হয়ে যায়।
একদিন সে ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। এ দৃশ্য দেখে তার ইংরেজির টিচার চুপি চুপি তার সামনে একটি সাদা খাতা মেলে ধরেন। বলেন, ‘তুই তো কবি হয়ে গেছিস রে। নে, লেকচার শোনা বাদ দিয়ে কবিতা লেখ। আর জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাক।’ টিচারের কথা শুনে ক্লাসের সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। তবে তুমুলের বন্ধু সৌধ হাসতে পারে না। সে বলে, ‘ও কিন্তু সত্যি কবি। কবিতা লেখে। ওর ব্যাগের ভিতর একটা কবিতার খাতা আছে। অনেকগুলো কবিতা লিখেছে।’ স্যার সৌধের কথা শুনে কৌতূহলী হন। ‘দেখি, দেখি। বার করত কবিতার খাতাটা।’
স্যারের এই আচরণে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে তুমুল। ব্যাগের চেন খুলে, খাতাটা বাড়িয়ে দেয় স্যারের হাতে। পুরো ক্লাস হাততালি দিয়ে ওঠে। স্যার পড়েন,
জানালা দিয়ে অবাক চেয়ে থাকা
খাতা ভরে পাখির ডানা আঁকা।
পাখির ডানায় রোদ ঝলমল করে
তোমার কথা আমার মনে পড়ে!
স্যার পড়া শেষ করেন, জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমুল কাকে মনে পড়ে রে তোর?’ স্যারের বলার ধরন দেখে পুরো ক্লাসে হাসির হুল্লোড় পড়ে যায়। ‘তুই তো ক্লাস সিক্সে পড়ে ইন্টারমিডিয়েটের কবিতা লিখে ফেলেছিস। বল, তোর কাকে মনে পড়ে?’
ক্লাসে আবার হাসি।
তুমুল দাঁড়িয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, ‘স্যার, আমার কাউকে মনে পড়ে না। এমনি এমনি লিখেছি।’
বিকেল চারটার সময় ছুটি হয় তুমুলদের। ছুটি হওয়ার পর ইংরেজির টিচার আতিক এসে দাঁড়ান তুমুলের সামনে। বলে, ‘তোর কবিতা কিন্তু চমৎকার হয়। আমিও এমন লিখতে পারি না।’ তুমুল চমকে ওঠে যেন, ‘স্যার, আপনিও কবিতা লিখেন?’
‘হ্যারে লিখি।’
তুমুল যেন আকাশের চাঁদ পেয়ে যায়।
‘সত্যিই স্যার আপনি কবিতা লিখেন?’
স্যার খুব খুশি হয়ে বলেন, ‘তিন সত্যি।’
‘আপনার কবিতা আমাকে পড়তে দেবেন?’
স্যার আরও খুশি হন। ‘চল, আজ আমি তোকে তোর বাসায় পৌঁছে দিই। অসুবিধা আছে কোনো?’
‘না স্যার নেই।’
তুমুল ইংরেজির টিচার আতিকের গাড়িতে ওঠে বসে। আজিমপুর থেকে গাড়িটা জিগাতলা স্যারের বাসায় এসে পৌঁছায়।
তুমুলের গা ছমছম করে ওঠে। স্যার একদিন বলেছিলেন, ‘সম্ভবত আমাদের বাড়িতে ভুত বাস করে।’ আবার বলেন, ‘যদিও আমি ভুত বিশ্বাস করি না।’
স্যার থাকেন পাঁচতলা বাড়ির চিলেকোঠায়। ছাদের ওপর দুটি ঘরে।
দরোজা খুললেন এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। মুখে কাঁচাপাকা দাঁড়ি। তুমুলকে বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বললেন, ‘এইটাকে কোত্থেকে ধরে আনলি।’
‘ভাইয়া ও আমার ছাত্র। কবি।’
‘কবি? বলিস কী। তুই এক কবি, ধরে এনেছিস আরেক পিচ্চি কবিকে।’ এই কথা বলে এমনভাবে হো হো করে হাসতে লাগলেন যে মনে হলো হাসির শব্দে বিল্ডিংটাই ভেঙে পড়বে।’
আতিক স্যার বললেন, ‘কিছু মনে করো না। আমার ভাইয়া একটু অসুস্থ।’ এ কথা বলে স্যার তার কবিতার খাতা বের করে তুমুলের হাতে দিলেন।
কবিতা পড়তে পড়তে ছাদের দিকে চোখ যায় তুমুলের। ছাদের এক পাশে একটি গাদা ফুলের গাছ। বেশ কিছু গাদা ফুল ফুটে আছে তাতে। আতিক স্যার মগে পানি ভরে সেদিকে যাচ্ছেন। গাছে পানি দেবেন।
‘আরে, আরে একি করছিস। এ অসময়ে গাছে পানি দিতে হয় না। এখন তো টবের মাটি গরম হয়ে আছে। তুই তো দেখি আস্ত পাগল। তুই আমাকে পাবনা মেন্টাল হাসপাতালে ভর্তি করেছিলি। এইবার আমি তোকে সেখানে ভর্তি করে দিয়ে আসব।’ এ কথা বলে স্যারের বড় ভাইয়া আবার হাসতে থাকেন।
টবের গাছে পানি না দিয়েই ঘরে চলে আসেন আতিক স্যার।
তুমুলকে জিজ্ঞেস করেন। ‘কি রে কেমন লাগছেÑআমার কবিতা?’
‘মোটামুটি, খুব একটা ভালো হয়নি।’ তুমুল কথাটা এমনভাবে বলে যে, মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অধ্যাপক মন্তব্য করছেন। আতিক স্যারের ফর্সা মুখটা কালো হয়ে যায়। এমন মন্তব্যে স্যার এমন কষ্ট পাবেন তুমুল তা ভাবেনি।
‘না। না স্যার। খুব যে খারাপ হয়েছে আমি সেটা বলছি না।’
স্যারের মন আরও খারাপ হয়ে যায়। পিছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছিলেন আতিক স্যারের বড় ভাইয়া।
‘ঠিক বলেছে পিচ্চি কবি। আতিকের কবিতা একটুও ভালো হয়নি। অথচ সেসব আতিক আমাকে জোর করে শোনায়।’Ñভাইয়া বলেন।
কথা শুনে আতিক স্যার মহাক্ষিপ্ত হয়ে যান। ‘যাও, এক্ষুনি বের হয়ে যাও তুমি।’ ঘর থেকে বড় ভাইয়া বের হয়ে গেলে আতিক স্যার ঘরের দরোজা বন্ধ করে দেন।
অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে তুমুল আর আতিক স্যার। কারও মুখে কোনো কথা নেই। এ সময়ই ইলেকট্রিসিটি চলে যায়।
‘স্যার, আমি বাসায় চলে যাই।’
‘কারেন্ট আসলে যাও। আমিই তোমাকে পৌঁছে দেব।’ স্যার বলেন।
স্যার মোবাইলের আলোটা জ্বালিয়ে বলে, ‘তুমি একটু বসো, ভাইয়া কোথায় গেল দেখে আসি।’
আতিক স্যার ঘরের ভাইরে চলে যান।
ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুই দেখা যায় না। কেমন ভয় ভয় লাগে তুমুলের। ঝাপসা বোঝা যায়, দেয়ালে বাঁধানো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি। তুমুল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেদিকে।
একি বিস্ময়। বাঁধানো ছবির ভেতর থেকে নেমে আসছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একি সত্যি। কী করবে তুমুল। কিছুই বুঝতে পারছে না।
‘কী হে কবি।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তুমুলকে বলছেন। তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।
‘তোমার কথায় স্যার দুঃখ পেয়েছেন?’
‘কবি। আমি স্যারকে দুঃখ দিতে চাইনি।’ তুমুল বিনয়ের সঙ্গে বলে।
রবীন্দ্রনাথ হাসেন। ‘স্যারের জন্য নিশ্চয় খারাপ লাগছে?’
‘জি, লাগছে।’
বাসার নিচে ভীষণ রকম চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যায়। ওই সময়ই কারেন্ট চলে আসে। ‘না, রবীন্দ্রনাথ তার সামনে দাঁড়িয়ে নেই। চোখ যায় তার দেয়ালের দিকে। রবীন্দ্রনাথ যেন তার দিকে তাকিয়ে হাসছেন।
বাসার নিচে কোলাহল, চেঁচামেচি আরও বাড়ে।
ছাদে গিয়ে তুমুল নিচে উঁকি দিয়ে দেখে।
তুমুলের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। একি। রাস্তায় পড়ে আছে বড় ভাইয়া। তার বুকের ওপর মাথা ঠুকে, ‘ভাইয়া ভাইয়া’ বলে চিৎকার করছেন আতিক স্যার।
গলির রাস্তায় গাড়িটাড়ি বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তায় পড়ে থাকা ভাইয়াকে ঘিরে আছে লোকজন। তুমুল ওপর থেকে দৌঁড়ে নিচে নামে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায় সেদিকে।
পিছন থেকে তুমুল স্যারের কাঁধে হাত রাখে। স্যার পিছন ফিরেই তুমুলকে বুকে জড়িয়ে ধরেন।
তুমুল কী করবে বুঝতে পারে না।
‘মাষ্টার সাহেবকে আগেই বলেছিলাম, চিলেকোঠা ভাড়া নিবেন না। বাড়িতে তেনারা থাকেন।’ ভিড়ের মধ্যে একজন বলে ওঠে।
লোকটা তেনারা অর্থে ভুত বোঝাচ্ছেন। তুমুল তা স্পষ্ট বুঝতে পারে।
পুলিশের গাড়ি ভাইয়াকে নিয়ে যায়।
চল্লিশ দিন পরের ঘটনা।
আতিক স্যার ভীষণ অন্যমনস্ক। পড়াতে তার মন বসছে না। হঠাৎ তিনি আবৃত্তি করেনÑ
জানালা দিয়ে অবাক চেয়ে থাকা
খাতা ভরে পাখির ডানা আঁকা
পাখির ডানায় রোদ ঝলমল করে
তোমার কথা আমার মনে পড়ে।
স্যার জানতে চান, বল তো এটা কার কবিতা। পুরো ক্লাস চিৎকার করে ওঠে, তুমুল, তুমুল, তুমুল।
লজ্জা লাগে তুমুলের। সে মাথা নিচু করে থাকে। হঠাৎ তার বুকে একটা কষ্ট ছড়িয়ে পড়ে।
বড় ভাইয়াকে ভীষণ মনে পড়ছে আতিক স্যারের। তুমুলেরও মনে পড়ছে তাকে।